পথ ও পথিক
-মুহাম্মদ শাওয়াল হোসাইন
গরম একটি কপির কাপকে টেবিলের উপর রাখা হলে সময়ের ব্যবধানে সেটি আস্তে আস্তে ঠান্ডা হতে থাকবে। তবে সেটি আর কখনোই বেশি গরম হয়ে উঠবে না।এটি বিজ্ঞানের তাপগতিবিদ্যার একটি সূত্র।ছোটবেলায় কতবার আওড়িয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
এই সূত্র মানুষের জীবনের সাথে অদ্ভুত ভাবে মিলে যায়। মাতৃগর্ভে যেদিন আমাদের রুহ তথা প্রাণকণা সঞ্চার হয়।ঠিক সেদিন থেকেই আমাদের উষ্ণতার শুরু। সেই উষ্ণতা আমরা ধীরে ধীরে হারাচ্ছি। হঠাৎ এমন একটা সময় আমাদের সামনে উপস্থিত হবে,যখন আমরা সমস্ত উষ্ণতা হারিয়ে স্তব্ধ, শীতল হয়ে যাব।সেদিন ছিন্নভিন্ন হবে আমাদের জাগতিক বন্ধন।এরই নাম মৃত্যু।
তবে এই মৃত্যুর স্বাদ থেকে বাঁচার জন্য মানবমন চেষ্টা করেছে যুগের পর যুগ।
বিশ্বজয়ী চেঙ্গিস খাঁ শেষ বয়সে সমরখন্দ এসেছিলেন যদি
সমরখন্দের আবহাওয়ায় তার শরীর কিছুটা সারে। চিকিৎসকদের হুকুম দিয়েছেন অমরত্ব পানীয় তৈরির।যে তৈরি করতে পারবে সে বেঁচে থাকবে, অন্যদের জন্য মৃত্যু দন্ড।
চীনের মিং সম্রাট খবর পেলেন,জিন সেং নামের এক গাছের মূলে আছে মৃত্যু থেকে বাঁচার গোপন রস। তিনি ফরমান জারি করলেন, রাজকীয় বাগানে এই বৃক্ষের চাষ করতে।
পারস্য সম্রাট দারায়ূস খবর পেলেন,এক গুহার ভেতরে টিপটিপ পানি পড়ে।পানির ফোঁটায় আছে অমরত্ব। সম্রাটের আদেশে চারিদিকে কঠিন পাহারা বসলো।
ফলাফল:তাদের কেউ সফল হয়নি।
Elixir of Life(অমরত্ব পানীয়) তৈরির চেষ্টায় বিজ্ঞানীরা কখনো থেমে থাকেনি।এটার সঙ্গে ওটা মেশান। আগুনে গরম করেন।ঝাঁকাঝাঁকি করেন।যে-কোন মূল্যেই মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু সবই পণ্ডশ্রম।
শুরুতে ভাবা হতো, একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর মৃত্যু ঘন্টা বেজে ওঠে। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে মৃত্যু ঘন্টা বলতে কিছু নেই, মানব দেহ অতি আদর্শ এক যন্ত্র।জরা,মানব দেহ আক্রমণের মূল কারণ হলো টেলোমার্স কণিকা গুচ্ছ।
এরা DNA-র অংশ, থাকে ক্রমোজমের শেষ প্রান্তে।যখনই জৈবকোষ ভাঙে,টেলোমার কণিকা গুচ্ছ ছোট হতে থাকে। আমরা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকি।(১)
বিজ্ঞানের পরিবর্তনশীল সূত্রের পর কুরআনের অবিচল সমাধান।সূরা আন নিসা (النّساء), আয়াত: ৭৮
أَيْنَمَا تَكُونُوا۟ يُدْرِككُّمُ ٱلْمَوْتُ وَلَوْ كُنتُمْ فِى بُرُوجٍ مُّشَيَّدَةٍ
অর্থঃ তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও।
জীবন আসলে একটা মরিচিকার নাম যেখানে মৃত্যুই হলো দ্রুব সত্য। দুনিয়ার জীবন বিশাল এক নাট্য মঞ্চের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এই দুনিয়ার উপমা হলো এমন এক মুসাফিরের মতোই, যে তার ভ্রমণে বের হয়েছে। পথিমধ্যে ক্লান্ত লাগছিল বলে সে একটা গাছের ছায়ায় একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা আরম্ভ করেছে। ‘
জামে তিরমিজি :২৩৭৭
আমাদের জীবনটা খুব ছোট। যেন শুরুর আগেই শেষ। কেন এসেছি,কী করছি, কোথায় যাচ্ছি -এই চিন্তাগুলো করা খুব জরুরি। কিন্তু আমরা তা করিনা।আমরা সন্ধান করিনা শেষ পথের। কেমন সে পথ? পিচডালা,না মেটো,না ডিজিটাল? ছোটবেলা থেকে আমাদের মাথায় সেট করা হয়েছে পুঁজিবাদি চিন্তা।,””লাইফ ইজ নট অ্যা বেড অফ রোজেজ।জীবনটা ফুলের বিছানা নয়।জীবন খুব কঠিন নয়,ঠিকে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা করা চাই। রেগুলার শেভের আড়ালে পাকা দাড়ি লুকাতে ব্যস্ত আমরা,কড়া মেকআফের আড়ালে প্রৌঢ়ার ভাজ পড়া ত্বক লুকানোর তীব্র প্রতিযোগিতা।
লেখা-পড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে।এ বাক্যের পেছনে নিরন্তর ছুটে চলা।আমরা একেকজন অট্টালিকা গড়ার চূড়ান্ত প্রতিযোগী।বস্তুবাদী সমাজে বস্তু কেনার টাকা থাকতে হবে নয়তো কমফোর্ট জোনে থাকতে পারবানা।এমন হাজারো নীতিবাক্য শৈশব কৈশোরে বপে দেওয়া হয় আমাদের মগজে।
দুনিয়া আমাদের সুখের সন্ধান দেয়,বস্তু ভোগের মাঝে।শেষ গন্তব্য শেখায়,’ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ’।আর এটাই ধ্রুব সত্য।
আচ্ছা যদি আমাদেরকে বলা হয়,মণিমুক্তা সমৃদ্ধ প্রাসাদ আমাদেরকে দেয়া হবে। প্রাসাদের নিচে থাকবে ঝর্ণা,সামনে ফুলের বাগান।আপনি চাইলেই এনে দেয়া হবে সবকিছু হাতের নাগালে। অনন্তকালের জন্য আপনি হবেন এই অপূর্ব সুন্দর প্রাসাদের মালিক।চাকচিক্যে ঘেরা সেই প্রাসাদ দেখে আপনি এতই বিমোহিত হবেন যে দুনিয়ার কথা মনেই থাকবে না।
এরকম একটি প্রাসাদের জন্য দোয়া করেছিলেন ফেরআউনের স্ত্রী আসিয়া।
সুরা তাহরিম: আয়াত ১১।
“”হে আমার প্রতিপালক জান্নাতে আপনার সন্নিকটে আমার জন্য একটি ঘর নির্মান করুন।””
এই প্রাসাদের মালিক হতে লাখ টাকা কিংবা রাজউকের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন খোদাভীতি।সাথে বৃত্তের অনুসরণ করা। ভাবছেন বৃত্ত আবার কী?
একটিমাত্র কেন্দ্র। কেন্দ্রের চারপাশে সুষম গোল রেখাটাই কেন্দ্র।কেন্দ্র ছড়া বৃত্ত সম্ভব নেয়।আবার রেখা এলোমেলো হলে বৃত্ত হবেইনা। না,আমি জ্যামিতিক জ্ঞান দিতে চাচ্ছি না।জীবনের মেইন গোলটা শেয়ার করছি মাত্র।
বৃত্তটা বুঝিয়ে বলি,বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু আল-কুরআন।কেন্দ্র থেকে যে অক্ষরেখা দিয়ে সফলভাবে সম্পূর্ণ বৃত্তটি আঁকতে পারব সেই অক্ষরেখাটি প্রিয়তম রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অক্ষরেখা থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে বৃত্তের বৃত্তীয় মান হারানো।
মৃত্যুই জীবনের নির্মম নিয়তি। জগতের সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো’জন্মিলে মরিতে হইবে ‘।
সূরা আল ইমরান (آل عمران), আয়াত: ১৮৫
كُلُّ نَفْسٍ ذَآئِقَةُ ٱلْمَوْتِ
অর্থঃ প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু।
আমাদের উচিত কবরের পাশে দাঁড়ানো,এতে আখিরাতের কথা মনে পড়ে।শেষ গন্তব্য স্থলের ভাবনায় বিভোর হওয় যায়।এজন্যই রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে কবর জিয়ারত করতে বলেছেন।
সুনানে আবি দাউদ:৩২৩৭
১)তথ্যসূত্র:লীলাবতীর মৃত্যু -হুমায়ূন আহমেদ”